রিভিউ: চাঁদের পাহাড় - বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়

চাঁদের পাহাড়
 বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়

 এডভেঞ্চারধর্মী উপন্যাসের প্রতি সেই ছোটবেলা থেকেই অন্যরকম আকর্ষণ আমার। আর এই আকর্ষণকে রসদ যুগিয়েছে এডভেঞ্চার হেনরী রাইডার হ্যাগার্ডের শী, রিটার্ন অব শী, এলান কোয়েটারমেন আন্ড দি হোলি ফ্লাওয়ার এসব অনুবাদকৃত উপন্যাসগুলো। উপন্যাসগুলো পড়লে মনে হতো আমি নিজেই যেন গহীনে বন জংগলে আবিস্কারের নেশায় ছুটে বেড়াচ্ছি। তখনও আমার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের "চাঁদের পাহাড়ের" আমার পরিচয় হয়নি। এক বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে চাঁদের পাহাড় বইটি পুরস্কারসরুপ পাই। বইটি পড়ে বার বার মনে হতে লাগলো এতদিনতো আমি এই বইটিই খুজছিলাম। এবার এডভেঞ্চারে খুজে পেলাম দেশী স্বাদ। আমার এপর্যন্ত পড়া সকল বইয়ের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে চাঁদের পাহাড়। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কখনো বিদেশ ভ্রমণ করেননি। চাঁদের পাহাড় লিখতে তিনি বিদেশি জার্নাল আর ম্যাগাজিন লব্ধ তথ্য ব্যবহার করে চাঁদের পাহাড় রচনা করেছেন যা আমার কাছে অত্যন্ত আশ্বর্য মনে হয়েছে। "চাঁদের পাহাড়" গল্পের কাহিনী সংক্ষেপ হচ্ছে একজন সাধারন কিন্তু এডভেঞ্চারপ্রিয় বাংগালী যুবক শংকর ঘটনাচক্রে পুর্ব আফ্রিকার দেশ উগান্ডায় চাকুরি নেয়। সেখানে পরিচয় হয় আলভারেজ নামক এক পুর্তগিজ অভিযাত্রীর সাথে যার উদ্দেশ্য আফ্রিকায় লুকিয়ে থাকা হিরের খনি খুজে বের করা। এডভেঞ্চারপ্রিয় শংকর আলভারেজ এর সাথে হিরার খনির খোজে বেরিয়ে পড়ে। তারা মাসের পর মাস হিরার খনির খোজে আফ্রিকার রিক্টার্সভেল্ট পর্বতমালা চষে বেড়ায়।

অভিযানের একপর্যায়ে গরিলা প্রজাতির দৈত্যকার প্রাণীর (স্থানীয় নাম বুনিপ)হাতে মৃত্যুবরণ করে। তখন শংকর হিরের খোজ বাদ দিয়ে লোকালয়ে যাবার পথ খুজতে শুরু করে। এমনই এক পর্যায়ে শংকর পথিমধ্যে একটি গুহার দেখা পায়। গুহায় প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ফেলে বেশ কয়েকদিন চেষ্টার পর গুহায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য নুড়ি পাথর দিয়ে চিহ্ন তৈরী করে গুহা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সেই গুহার স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ একটি নুড়ি পাথর সাথে রেখে দেয়। অনেক কস্ট, চেস্টার পর সে এক মরুভূমি ছোট্ট এক গুহায় হাজির হয়, সেখানে পড়ে থাকা অন্য এক অভিযাত্রীর কংকাল, চিঠি আর হিরের টুকরার সাহায্যে আবিস্কার যে তার সাথে যে নুড়ি পাথর আছে সেটা অন্যকিছু নয় একদম খাটি হিরা আর এটা সে যে গুহাতে পেয়েছিলো সেটায় সেই কাংক্ষিত হিরার খনি।

এরপর আরো অবর্ণনীয় কস্টের পর এক সার্ভে দলের মাধ্যমে শংকর এযাত্রায় সাক্ষাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় এবং তাদের সাহায্যে দক্ষিণ আফ্রিকার রোডেশিয়ার রাজধানী সলসবেরীতে পোছায়। একটু জন্যে হাত থেকে ফসকে যাওয়া হিরের খনির সন্ধানে যাওয়ার জন্য শংকর আবার নিজেকে প্রস্তুত করে। গল্পের নায়ক শংকরকে চাঁদের পাহাড় পাঠকারী প্রত্যেক পাঠকের নিজের প্রতিরুপ হিসেবেই খুজে পায়। উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকের আকর্ষণ সমানভাবে ধরে রাখে। এই উপন্যাস পাঠের সময় আফ্রিকার বিভিন্ন স্থান, পাহাড়, বন জংগল, জীবজন্তু সবই যেন চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে। চাঁদের পাহাড় পড়ে একসময় মনে হয় বেরিয়ে পড়ি দুঃসাহসিক অভিযানে। একজন বাংগালী লেখকের হাত ধরে বিদেশী পটভূমিতে এমন উপন্যাসের জন্ম হতে পারে তা আমি চাঁদের পাহাড় না পড়লে বুঝতে পারতাম না। চাঁদের পাহাড় যখন লেখা হয় তখন মানুষ চাইলেই ভোগলিক খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করতে পারতো না যা আজ গুগল ম্যাপ, উইকিপিডিয়া ইত্যাদির মাধ্যমেই সহজেই সম্ভব। তাই এই উপন্যাসটিতে কিছু ভোগলিক তথ্যের কিছু গড়মিল রয়েছে তবে সেটা লেখার গুণের কাছে অত্যন্ত নগন্য বিষয়। চাঁদের পাহাড় যতবার পড়ি ততবারই মনে হয় প্রথমবার পড়ছি এবং প্রতিবারই নতুন করে রোমাঞ্চিত হয়। এই বই আমার কাছে সবসময় সেরা হয়েই থাকবে। ধন্যবাদ চাঁদের পাহাড়ের মতো একটি অনবদ্য উপন্যাসের সৃষ্টিকারী বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়কে এবং ধন্যবাদ সেই বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজনকারীদের যাদের মাধ্যমে এই বই আমার হাতে এসেছিলো।

No comments:

Post a Comment

১০ হাজার টাকার মধ্যে কোন জুতা কিনা উচিত?

  আপনি যদি  ১০ হাজার টাকার মধ্যে কোন জুতা কিনতে চান, তাহলে আপনার জন্য কিছু পরামর্শ দিতে পারি। প্রথমে, আপনার জুতা কেনার উদ্দেশ্য কি তা বেছে ন...